বুকের ওপর বাস চালিয়ে দিয়ে হত্যার আগে বাসের ভেতরেই কাঠের ব্রাশ দিয়ে পেটানো হয় রেজাউল করিম রনিকে। বাসের হেলপার মানিক ও তার অপর সহযোগীরা এতটাই হিংস হয়ে উঠেছিল যে, বাসযাত্রীদের প্রতিবাদকে তোয়াক্কা না করে ক্লান্ত রনিকে মুহূর্তে বাসের নিচে ছুড়ে ফেলে দেয়। তখনও ক্ষিপ্ত বাসচালক দিদারুল আলম রনির শরীরকে তার বাসের চাকায় দুমড়ে-মুচড়ে ৫০ ফুট টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়।
এ সময় বাসযাত্রীরা ‘লোকটা মরে গেল বুঝি’ বলে চিৎকার করতে থাকে এবং যাত্রীদের প্রতিরোধের মুখে চালক বাস থামিয়ে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে যায়। বাসের হেলপারও দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। ওই সময় বাসের মধ্যে তাদের আরও কয়েকজন সহযোগী ছিলেন।
তারাও সুযোগ বুঝে গা ঢাকা দেয়। চট্টগ্রাম নগরজুড়ে বলাবলি হচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিটি গেটের অদূরে কালিরহাট এলাকায় সোমবারের এ ঘটনা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল পরিবহন শ্রমিকরা এতটুকু বদলায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার দুই শিক্ষার্থী রাজিব-দিয়ার মৃত্যু ও চট্টগ্রামে পায়েলসহ তিন ছাত্রকে চাপা দিয়ে হত্যার পর দেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠলেও পরিবহন শ্রমিকরা এতটুকু বদলায়নি। তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
এর সবশেষ প্রমাণ- ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডার তুচ্ছ ঘটনায় রনিকে বাসের চাকার নিচে ফেলে হত্যা। ঘাতক বাসের চালক ও হেলপারের পরিচয় মিললেও এখনও তারা অধরা। লুসাই পরিবহনের এ বাসটির বৈধ কাগজপত্রও খুঁজে পায়নি পুলিশ।
বাসে কী ঘটেছিল সেদিন : সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জিল্লুর রহমান নামে রনির এক প্রতিবেশী সিটিজি নিউজকে বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি থেকে কালিরহাটে যাওয়ার উদ্দেশে বাসে উঠেছিল রনি।
দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে (সোমবার) রনি ফোন দিয়ে জানায়, ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছে বাসের হেলপার এবং চালক। তাকে মারধরও করছে। রনি আমাকে কালিরহাট এলাকায় আসতে বলেন। আমি দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে কালিরহাটের দিকে যাই। এ সময় দেখি চট্টগ্রামের নিউমার্কেটগামী ৪ নম্বর রুটের সিটি সার্ভিস বাস দ্রুত চলে যাচ্ছে। বাসের চাকার নিচে থেঁতলানো কাউকে দেখতে পাই। ভাবতে পারিনি ওই থেঁতলানো লোকটিই রনি। ওই সময় যাত্রীরা চিৎকার করছিল। বাসটি থামার পর কাছে যেতেই দেখি জানালা দিয়ে একজন লাফ দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। আরও কয়েকজন পেছনে। তখনও বুঝতে পারিনি ওই বাসের চাকার নিচে পিষ্ট হয়েছে ছোট ভাই রনি।’
বাসযাত্রীদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাসের ভেতরেই কয়েকজন মিলে রনিকে বাস ঝাড়ু দেয়ার কাঠের শক্ত ব্রাশ দিয়ে পেটানো হয়। বাসচালক দিদার ও তার সহযোগী মানিকসহ কয়েকজন মিলে কালুশাহ মাজার এলাকার স্টপেজ এলাকায় রনিকে মারধর করে। পরে তাকে বাসের দরজা দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে বুকের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে দেয়া হয়। অন্তত ৫০ ফুট দূরে গিয়ে থামে রনির রক্তাক্ত মরদেহ।’
মো. সাইফুল ইসলাম নামে ওই বাসের এক যাত্রী সিটিজি নিউজকে বলেন, ‘আমি বাংলাবাজার থেকে ওই বাসে উঠেছিলাম। বাসের পেছন দিকে বসে মোবাইলে কথা বলছিলাম। তবে পাক্কার মাথা নামক স্টপেজে না থামিয়ে যখন বাসটি দ্রুত চালাচ্ছিল, তখন যাত্রীরা ‘লোকটি মরে গেল বুঝি’ বলে চিৎকার করছিল। পরে কয়েকজন যাত্রী চালককে গাড়ি থামাতে বাধ্য করে। বিপদ আছে আঁচ করতে পেরে চালক জানালা দিয়ে লাফিয়ে এবং তার পেছনে হেলপার ও আরও কয়েকজন মোস্তফা হাকিম ডিগ্রি কলেজের রোড দিয়ে পালিয়ে যায়। তাদের আটকাতে পেছনে পেছনে দৌড় দিলেও ধরতে পারিনি।’
ঘন ঘন জায়গা বদল করছে চালক-হেলপার : লুসাই পরিবহনের ঘাতক বাসের মালিকের নাম শাহাবুদ্দিন। বাসের চালক দিদারুল আলম (৩৫) ও তার হেলপার মানিকের (৩২) বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায়। থাকেন নগরীর কালুশাহ মাজার এলাকায়। আকবর শাহ থানার ওসি জসিম উদ্দিন সিটিজি নিউজকে বলেন, বাসটির রুট পারমিট, ফিটনেস ছিল কিনা সে বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই বিস্তারিত বলতে পারছি না। চালক ও হেলাপরকে গ্রেফতারেরও চেষ্টা চলছে। শিগগিরই তারা ধরা পড়বে। রাতেই (মঙ্গলবার) মামলা হচ্ছে।
আকবর শাহ থানার এসআই ধিমান মজুমদার সিটিজি নিউজকে জানান, ঘাতক বাসের চালক ও হেলপার ঘন ঘন স্থান বদল করায় গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। রনিকে চাপা দেয়া লুসাই পরিবহনের বাসটি নগরীর ৪ নম্বর রুটে চলাচল করত। বাসটি অবৈধভাবেই চলাচল করত বলে আমাদের ধারণা। এজন্য বিআরটিএতেও আমরা যোগাযোগ করছি।
পিতৃহারা সাবা কেবল অপলক তাকিয়ে থাকছে : দেড় বছরের কন্যা সাবা বুঝে উঠতে পারছে না যে, এই বয়সেই সে কী হারিয়ে ফেলেছে। বাড়িভর্তি মানুষ দেখে কখনও মায়ের কোলে, কখনও দাদার কোলে, কখনও বা অন্য স্বজনের কোলে গিয়ে ঠাঁই নিচ্ছে। বাড়ির উঠোনে রাখা লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স, এত মানুষের উপস্থিতি দেখে মাঝে মধ্যেই সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছে। অ্যাম্বুলেন্সের জানালার ফাঁক গলে বাবার নিথর দেহের দিকেও তাকিয়ে আধো আধো গলায় বলছিল- আব্বু আব্বু। স্বজনরা ‘আব্বু ঘুম’ বলে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। এসব দৃশ্য দেখে বাড়িভর্তি মানুষ চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিল না। চমেক হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে রনির লাশ গ্রামের কালিরহাটের ফার্সিমিয়ার বাড়ির উঠোনে আনা হলে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। অকালে বিধবা হয়ে যাওয়া রনির স্ত্রী ও সন্তানহারা মা আনোয়ারার আর্তনাদে উপস্থিত সবার চোখের কোণে জমা হচ্ছিল পানি। অনেকের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু।
রনির জন্যই দেশে এসেছিলাম : আমেরিকা প্রবাসী মা আনোয়ারা বেগম বারবার বলছিলেন- এখন কার জন্য দেশে আসব? মায়ের কান্না যেন এ সময় কিছুতেই থামছিল না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মা আনোয়ারা বলছিলেন, স্ত্রী-সন্তানসহ রনিকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য গত ডিসেম্বরে মার্কিন দূতাবাসে কাগজপত্র জমা দেয়া হয়েছে। আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারে রনিও বেশ আগ্রহী ছিল। স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে আনোয়ারা আমেরিকায় বসবাস করছেন দীর্ঘদিন ধরে। কাঁদতে কাঁদতে আনোয়ারা বলছিলেন, রনির জন্য সব সময় মন কাঁদত। ওর জন্যই দেশে ছুটে আসতাম। কিন্তু ঘাতক বাসের চালক-হেলপার আমাদের সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। মঙ্গলবার বাদ আসর বাড়ির পার্শ্ববর্তী মোস্তফা হাকিম ডিগ্রি কলেজ মাঠে রনির জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।
চালক-হেলপারের আচরণে উদ্বেগ মহিলা পরিষদের : সিটিজি নিউজ রিপোর্ট জানায়, বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে যাত্রী হত্যা ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সংস্থাটি বাসচালক ও হেলপারের দ্রুত শাস্তির দাবিও জানিয়েছে। সংগঠনের সভাপতি আয়শা খানম ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বিবৃতিতে জানান, একজন যাত্রীর এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় মহিলা পরিষদ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, ক্ষুব্ধ এবং মর্মাহত। তারা বলেন, লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শীরা ঘাতক চালককে পুলিশের কাছে সোপর্দ করলেও তারা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জামিন পেয়ে যাচ্ছে, যা জনমনে আরও হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার করছে। ঘাতক চালক ও হেলপারকে গ্রেফতার ও আইনের আওতায় এনে দ্রুত উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানান তারা।
সিটিজি নিউজ/কে.বি.আর