রাউজানে চুরি করতে আসা দুই চোর বিক্ষুব্ধ জনতার পিটুনিতে নিহত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার ভোর রাতে উপজেলার পাহাড়তলী ইউনিয়নের ঊনসত্তরপাড়া গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। নিহত দুই চোরের কোমর থেকে পুলিশ একটি রিভলভার ও একটি দেশীয় তৈরি পাইপগান পেয়েছে। নিহতরা হলো, একই ইউনিয়নের খানপাড়ার মৃত হামদু মিয়ার ছেলে মো. মোক্তার (২৮) ও একই এলাকার কালু মিয়ার ছেলে সাইফুল ইসলাম (২৭)। নিজেদের বাড়ি থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে চুরি করতে এসে গণপিটুনির শিকার হয় ওই দুই চোর।
স্থানীয় জনসাধারণ ও পুলিশ জানায়, নিহত দু’জনেই এলাকার চিহ্নিত চোর। তাদের বিরুদ্ধে ইয়াবা, চুরি, মারামারির মামলা ও অভিযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকবার তারা জেলও খেটে জামিনে বেরিয়ে আসে। পাহাড়তলী ইউপি’র ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আমীর হোসেন বলেন ‘শুক্রবার (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত) ভোরে মোক্তার ও সাইফুলসহ তাদের ৪-৫ জন সঙ্গীয় চোর ঊনসত্তরপাড়া ভুপোল চৌধুরী বাড়ির শ্যামল দাশের ঘরে ঢুকে দুটি মোবাইল চুরি করে। এরপর তারা পাশ্ববর্তী সিরাজ কলোনীর ভাড়াটিয়া ব্যবসায়ী শাহ আলম ও পাশের বাসিন্দা আদিনাথ দাশের ঘরের দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশের চেষ্ঠা করে। এসময় ভুপাল চৌধুরী বাড়িতে চুরির কারণে সজাগ লোকজন চোর চোর বলে চিৎকার করে। ব্যবসায়ী শাহ আলম ও পাশের বাসিন্দা আদিনাথ দাশের পরিবারও চোরদের দেখে চিৎকার করে। এক পর্যায়ে এলাকা ও আশে-পাশের জনতা এসে ঘেরাও করে দুই চোরকে আটক করে। অন্য কয়েকজন চোর পালিয়ে যায়।’ ব্যবসায়ী শাহ আলমের মেয়ে ঝুমা আকতার ও পাশ্ববর্তী বাসিন্দা আদিনাথ দাশের স্ত্রী শিল্পী দাশ বলেন ‘আমাদের ঘরের দরজা ভাঙ্গার পর যখন এলাকার লোকজন এসে হৈচৈ শুরু করে, তখন আমরাও চোর চোর বলে চিৎকার করি। এরপর জনগণ তাদের ধাওয়া করলে দুই চোর পাশের পুকুরে পড়ে যায়। এসময় জনগন তাদের দুইজনকে ধরে ফেলে।’ স্থানীয় লোকজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শতাধিক লোকজন দুই চোরকে ধরে লাটিসোটা, গাছ এবং যার যা আছে তা দিয়ে মারতে মারতে পাশ্ববর্তী ৩ নম্বর ওয়ার্ডের গৌরশংকর হাটে নিয়ে যায়। সেখানে বাজার শেডের পাকা পিলারের সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে জনতা তাদের দু’জনকে বেশ কয়েকদফা পিটুনি দেয়। এতে ঘটনাস্থলে তাদের মৃত্যু হয়।’ স্থানীয়রা জানান, কেউ কেউ চোরদের চোখে মরিচের গুড়াও দিয়েছে। ঘটনাস্থলে মরিচের গুড়া পড়ে ছিল। ধৃত চোরের মধ্যে মোক্তারের চুলও কেটে দেয় স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা।
গৌরশংকর হাটের চা দোকানদার মো. ইদ্রিছের ছেলে প্রত্যক্ষদর্শী কলেজ পড়ুয়া মো. বাদশা বলেন, ‘বহু মানুষ আটক দুই চোরকে হাতে, গাছ, লাটিসোটা দিয়ে মারতে দেখি। সকাল প্রায় ৮টা পর্যন্ত তাদের নড়াচড়া দেখেছি। এরপর তারা মারা যায়।’ বাজারের ইত্যাদি স্টোরের স্বত্বাধিকারী রতন বণিক বলেন ‘সকাল সাতটায় দোকানে এসে দেখি টানা হেচড়া করে ৫০-১০০ মানুষ দুই চোরকে গৌরশংকর হাট বাজারে নিয়ে নিয়ে আসে। এরপর দুই চোরকে মারা যাওয়া অবস্থায় দেখি।’ ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার কামরুল ইসলাম বলেন ‘শুক্রবার ভোর চারটার পর ঊনসত্তরপাড়া ভুপাল চৌধুরী বাড়ির এক ছেলে আমাকে ফোন করে বলে আমাদের এখানে চোর ঢুকেছে, আমরা দুইজনকে ধরে ফেলেছি। তখন আমি তাকে বলি, ধৃতদের বেঁধে পুলিশকে খবর দেন। এরপর শুনি দু’চোরকে গৌরশংকর হাটে নিয়ে গেছে। এরপর বাজারে এসে দেখি দু’জনের মৃতদেহ বাজার শেডের পাকা পিলারের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। পরে থানা পুলিশকে খবর দিই।’ ঘটনার পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে থানা থেকে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। বেলা ১২টার পর আসেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেপায়েত উল্লাহ। তিনি জানান, বাজার শেডের পিলারের সঙ্গে বাঁধা অবস্থা থেকে উদ্ধারের পর মোক্তারের পেছনে কোমর থেকে একটি রিভলভার ও সাইফুলের কোমর থেকে দেশীয় তৈরি পাইপগান পাওয়া গেছে।’
ওসি জানান, সাইফুলের বিরুদ্ধে ইয়াবা, চুরি, মারামারিসহ দুটি ও মোক্তারের বিরুদ্ধে একটি চুরির মামলার খোঁজ পেয়েছি। এরমধ্যে সাইফুল দুইবার, মোক্তার একবার জেলও কেটেছে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পেয়েছি। এছাড়া লোকজন তাদেরকে চুরির অপরাধে বেশ কয়েকবার আটক করেছে। তারা পেশাদার চোর এবং মাদকাসক্তও। তারা ইয়াবা, হিরোইন, মদসহ বিভিন্ন নেশাজাত দ্রব্যও সেবন করে। পাহাড়তলী ইউপি’র চেয়ারম্যান রোকন উদ্দিন বলেন ‘পাহাড়তলীর ঊনসত্তপাড়ার ২.৩ নম্বর ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় প্রতিদিন চুরির কারণে অতিষ্ঠ ছিল। মানুষ তাদের ধরার জন্য সজাগ ছিল। পাহারাও দেয় কয়েকটি এলাকায়। শুক্রবার ভোর চারটার চুরি করতে গেলে এলাকার মানুষ জড়ো হয়ে দুই চোরকে পিটুনি দিয়ে মেরে ফেলে।’ পুলিশ জানায়, দুপুরে নিহত দুইজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ময়না তদন্তের জন্য লাশ মর্গে পাঠানোর প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে পুলিশ। দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে আসেন রাউজান-রাঙ্গুনিয়া সার্কেলের এএসপি জাহাঙ্গীর আলম। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখা যায়, নিহতদের মধ্যে সাইফুলের পরণে ছিল জিন্স প্যান্ট ও ফুল শার্ট। গলায় চিল একটি স্বর্ণের রংয়ের চেইন। আর মোক্তারের পরণে ছিল ত্রি কোয়াটার প্যান্ট ও হাফহাতা গেঞ্জি। মোক্তারের মুখে, বাম হাতে, পায়ে চিদ্র ছিল। দু’জনের পুরো শরীরে আঘাত ছিল। এদিকে ঘটনাস্থল থেকে নিহতদের বাড়ি আধা কিলোমিটার দূরত্বে হলেও দু’জনের পরিবারের কেউ ঘটনাস্থলে আসেনি।’ ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী থানার এসআই মহসিন রেজা বলেন ‘নিহতদের পরিবারের কেউ শুক্রবার রাত ৮টা পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। লাশ ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে।’
চট্টগ্রাম খবর/কে.বি.আর